প্রচ্ছদবিশ্লেষণযুক্তি-তর্কশিক্ষা
ট্রেন্ডিং

শিক্ষার মুক্তি: রাষ্ট্র সংস্কারের সফলতা ও জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থা

গত ৫ই আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে দানবীয় ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের মাধ্যমে জাতির পুনর্গঠনের সুবিশাল সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। গত ৫৩ বছরে গড়ে ওঠা ফ্যাসিস্ট শাসনব্যবস্থাকে ভেঙে নতুন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে না পারলে বাঙালি জাতিকে একাত্তরের মত আরেকটি ‘বেহাত বিপ্লব’ সাক্ষী হতে হবে।

বর্তমানে রাষ্ট্রের জনগণের সম্মিলিত অভিপ্রায় হচ্ছে একটি কল্যাণকর ও গণতান্ত্রিক বন্দোবস্ত, যা বাস্তবায়নের নিমিত্তে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক ব্যবস্থাগুলি সংস্কারের জন্য ৬ টি কমিশন গঠন করেছে। এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই।

সংবিধান, নির্বাচন, বিচার ব্যবস্থা, পুলিশ, জনপ্রশাসন ও দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কারের জন্য কমিশন গঠন নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। তবে এই প্রচেষ্টাগুলির পাশাপাশি শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কারকে সমান অগ্রাধিকার দেওয়া অত্যন্ত প্রয়োজন। শিক্ষা হল সেই ভিত্তি, যার উপর দাঁড়িয়ে রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তন দীর্ঘমেয়াদী ও স্থায়ী হয়।

ঔপনিবেশিক শাসনামলে ‘প্রশাসনিক কর্মচারী’ তৈরীর উদ্দেশ্যে ভারতীয় উপমহাদেশে ‘রক্তে মাংসে ভারতীয়, কিন্তু চিন্তায়-চেতনায় বৃটিশ’ এক আজ্ঞাবহ ভৃত্য শ্রেণী উৎপাদনের জন্য ‘শিক্ষা ব্যবস্থা’ শীর্ষক যেই কারখানা বৃটিশ শাসকেরা গড়ে তুলেছিল, সেই ব্যবস্থাকে কোন শাসকই পরিবর্তন করতে পারেনি। অথবা এই আজ্ঞাবহ শ্রেণী মূলত শাসকদের স্বার্থ রক্ষা করে বলে কোন শাসকই এই ব্যবস্থাকে পরিবর্তন করতে চায়নি। ফলে পাকিস্তান আমল এবং ৫৩ বছরের স্বাধীন বাংলাদেশে বিভিন্ন সরকারের আমলে এই শিক্ষা ব্যবস্থা ঔপনিবেশিক কাঠামো থেকে মুক্ত তো হয়ইনি, বরং তা বিভিন্ন আমলের শাসক সরকারের হাতে ক্রমেই অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়েছে।

আরো পড়ুন

গত ১৫ বছর শেখ হাসিনা সরকারের আমলে ফ্যাসিবাদের কালো থাবা বসিয়ে যে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক ব্যবস্থাকে অকার্যকর করা হয়েছে তার মধ্যে শিক্ষাব্যবস্থা অন্যতম। এই ঔপনিবেশিক কেরানী তৈরীর শিক্ষা ব্যবস্থাকে ভেঙ্গে নতুন করে ‘জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থা’ গড়ার বিকল্প নেই। রাষ্ট্র সংস্কারের যে মহাযজ্ঞ বর্তমানে চলমান, তার সফলতা দীর্ঘমেয়াদী ও স্থায়ী করতে এই নতুন জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

প্রথমত, নতুন এই জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থা একটি তথ্যসমৃদ্ধ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে সক্ষম নাগরিকত্ব গড়ে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। যা একটি সংস্কারকৃত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে কার্যকারি করে তোলার জন্য অপরিহার্য হবে। এই সংস্কারকালীন সময়ে, যখন রাষ্ট্র উল্লেখযোগ্য সংস্কারের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তখন আমাদের এমন একটি জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থার প্রয়োজন যা সমালোচনামূলক চিন্তাশীল নাগরিক গড়ে তুলবে। এই নাগরিকগণ শুধু নির্বাচনেই অর্থবহভাবে অংশগ্রহণ করবে না, বরং তারা সংস্কারকৃত সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলিকেও জবাবদিহিতার অধীনে আসতে বাধ্য করবে। উদাহরণস্বরূপ, নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার তখনই সফল হবে, যখন নাগরিকেরা প্রথমত তাদের অধিকার এবং একই সাথে তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন হবে।

দ্বিতীয়ত, শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সমতাভিত্তিক সমাজ গঠনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বর্তমান অর্ন্তর্বতীকালীন সরকার বা পরবর্তীতে যারা সরকার গঠন করবে তাদের প্রধান অগ্রাধিকার হওয়া উচিত প্রায় ভঙ্গুর ও পরনির্ভরশীল বর্তমান অর্থনীতিকে ভেঙ্গে একটি আধুনিক, অন্তর্ভুক্তিমূলক, বহুমুখী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা। আর সেই সংস্কারকৃত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা ও জ্ঞানভিত্তিক নাগরিক গড়ে তুলতে সক্ষম এমন একটি জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়ন করার কোন বিকল্প নেই।

তৃতীয়ত, শিক্ষা হল সেই মাধ্যম, যার মাধ্যমে সহনশীলতা, বহুত্ববাদ ও সামাজিক সংহতির মূল্যবোধ গড়ে তোলা যায়। শাসনামলকে দীর্ঘায়িত করতে ফ্যাসিবাদী সরকারের অন্যতম একটি কৌশল হলো সমাজের মানুষদের মধ্যে বিভক্তি গড়ে তোলা। বিগত ফ্যাসিবাদী সরকার জাতিসত্ত্বার পরিচয়কে ধর্মীয় পরিচয় এর মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে, বাংলাদেশের ঐতিহ্যগত সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ হওয়া থেকে বিরত রাখতে চেয়েছিল। কাজেই ফ্যাসিবাদী শাসন পরবর্তী প্রেক্ষাপটে জাতীয় ঐক্য বিনির্মাণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই ঐক্যবদ্ধ সমাজ বিনির্মাণ এর জন্য এমন একটি জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রয়োজন, যার মাধ্যমে সহনশীলতা, বহুত্ববাদ ও সামাজিক সংহতি প্রাধান্য পাবে।

অর্থাৎ শিক্ষা সংস্কার কেবল অন্যান্য সংস্কারের সম্পূরকই নয়; বরং এটি হল সেই ভিত্তি, যার উপর অন্যান্য সকল সংস্কারের সফলতা নির্ভর করবে। তবে অন্যান্য মৌলিক ব্যবস্থাগুলো সংস্কারের প্রভাব আশু অনুভব করা গেলেও শিক্ষার সংস্কার এর প্রভাব ততটা তাৎক্ষনিক নয়। কিন্তু শিক্ষাব্যবস্থা সংস্কারের প্রভাবই সবচেয়ে টেকসই। প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনুস এর নেতৃত্ত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শুরু থেকেই বলে আসছেন রাষ্ট্র সংস্কার এই সরকারের অন্যতম অগ্রাধিকার। শিক্ষা হতে পারে ভবিতব্য সেই সংস্কারকৃত রাষ্ট্রের মেরুদণ্ড।

ইতোপূর্বে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট থেকে আলোচনা করেছি, কোন শাসকই তার শাসনব্যবস্থাকে জবাবদিহি করবে এমন স্বার্থবিরোধী শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়ন করতে আগ্রহী হয় না। কাজেই কোন দলীয় সরকারের অধীনে শিক্ষাব্যবস্থার মুক্তি সন্দিহান। অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জনগণের সম্মিলিত অভিপ্রায়ে গঠিত এই সরকারের উচিত অনতিবিলম্বে একটি স্বাধীন শিক্ষা কমিশন গঠন করে গণকল্যাণকর ‘জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থা’র ভিত্তি রচনা করে শিক্ষার মুক্তি নিশ্চিত করা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button