যুক্তি-তর্ক
ট্রেন্ডিং

লেজুরবৃত্তির বদলে প্রয়োজন ছাত্র সংসদ নির্বাচন

ছাত্র জনতার রক্তক্ষয়ী এক গণ অভ্যুথানের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ ১৬ বছরের স্বৈরশাসনের পতনের মধ্য দিয়ে পরিবর্তনের আকাঙ্খায় বাংলাদেশ। কোটা সংস্কার আন্দোলন পরিণত হয় বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে। কিন্তু, তৎকালীন সরকারের স্বৈরাচারী আচরণ ও রাষ্ট্রীয় বাহিনী কর্তৃক ছাত্র- জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি ও হত্যার প্রতিবাদে এই আন্দোলন রুপ নেয় স্বৈরাচার বিরোধী এক দফার সরকার পতনের আন্দোলনে। ছাত্র- জনতার আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী। নোবেল বিজয়ী বাঙালি অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে গঠিত হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।

ছাত্র-জনতার এই গণঅভ্যুথানের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে। কোন রাজনৈতিক দলের আহ্বানে এই আন্দোলনের সূত্রপাত হয়নি। এমন কী কোন একক ব্যক্তির নেতৃত্বেও হয়নি। এই আন্দোলনের সূত্রপাত হয় সাধারণ শিক্ষার্থীদের আহ্বানে। পরবর্তীতে যে সংগঠন এই আন্দোলনকে চালিয়ে নিয়ে যায় সে সংগঠন সম্পূর্ণ অদলীয় বৈশিষ্ট্যের। যার ফলে স্বল্প সময়ের মধ্যে সাধারণ শিক্ষার্থী ও জনতা এই আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

ছাত্রদের আহ্বানে জনতার স্বতঃফুর্ত অংশগ্রহণে হওয়া এই আন্দোলনকে অনেকেই অরাজনৈতিক আন্দোলন বলার চেষ্টা করলেও এটি কোনভাবেই অরাজনৈতিক আন্দোলন ছিলো না। যেমন বিগত স্বৈরাচারী সরকারের সময় অধিকাংশ আন্দোলনই হয়েছিলো অদলীয় বৈশিষ্ট্যির। বরং, এই আন্দোলনগুলোই দেশে অদলীয় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডকে আরও স্পষ্ট করে তুলেছে।

গণঅভ্যুথান পরবর্তী সময়ে এমনকি আন্দোলন চলাকালীন সময়েও দাবী উঠেছে শিক্ষাঙ্গনে ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করার। শিক্ষার্থীদের এই দাবি একেবারে অযৌক্তিক নয়। কিন্তু, যে দেশের সংকটময় মূহুর্তে বারবার শিক্ষার্থীরা জেগে উঠেছে সে দেশে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করা যায় কিভাবে। ১৯৫২-র ভাষার রাষ্ট্রীয় অধিকার প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে ষাটের দশকের স্বাধিকার ও একাত্তরের সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রাম, নব্বইয়ের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন এবং সর্বশেষ ২০২৪ সালে দেশের কল্যাণে অন্যায়ের বিরুদ্ধে ছাত্রদের যে আত্নত্যাগ, ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করা হলে তা হবে এই বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে শহীদ হওয়া ছাত্র- জনতার সঙ্গে প্রতারণা।

আরো পড়ুন

আবার, দলীয় সরকার ক্ষমতায় থাকলে সেই দলের ছাত্র সংগঠনের যে রুপ দেখা যায় সেটাও ভয়াবহ। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠন যে ভয়াবহ রুপ ধারণ করে তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ দেশের অন্যতম শীর্ষ বিদ্যাপীঠ বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়- বুয়েটের মেধাবী শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ এর হত্যাকাণ্ড। আবরারের হত্যায় অভিযুক্তরা বুয়েটের শিক্ষার্থী এবং তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার পদধারী নেতা। দেশের সর্বোচ্চ মেধাবীদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এই হত্যাকাণ্ডে মর্মাহত ও হতবাক হয়েছিলো পুরো দেশবাসী।

মূলত, আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডের পর থেকেই বিভিন্ন মহলে আলোচিত হচ্ছিলো ছাত্ররাজনীতি বন্ধের কথা, এর সাথে যুক্ত হয়েছিলো শিক্ষক রাজনীতি বন্ধের আলোচনাও। দেশের প্রতিটি সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক ও ছাত্রদের দলীয় রাজনীতি মারাত্নক ভয়াবহ আকার ধারণ করেছিলো বিগত ১৬ বছরে। বিভিন্ন পদ পদবীর লোভে শিক্ষকদের সরকারী দলের লেজুরবৃত্তির রাজনীতি খুবই স্বাভাবিক ঘটনায় রুপ নিয়েছিলো। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন এমনকি শিক্ষকদেরও উপাচার্য বিরোধী আন্দোলন করতে দেখা গিয়েছে বিগত বছর গুলোতে।

ছাত্ররাজনীতির অবস্থা খুবই ভয়াবহ। প্রায় সর্বত্রই ছাত্রনেতাদের নামে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসাসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের অভিযোগ নব্বেই পরবর্তী সময় থেকেই। অভ্যন্তরীণ কোন্দল, ভিন্নমতের সংগঠনকে সহ্য করতে না পারার মতো কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে অনেক। কোটা সংস্কার আন্দোলনের শুরুর দিকে তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ঘটিয়েছিলো নারী শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতন ও রক্তাত করার মতো নজিরবিহীন ঘটনা। যার ফলশ্রুতিতে তারা বিতাড়িত হয় হল ও ক্যাম্পাস থেকে।

ছাত্ররাজনীতি আসলে বর্তমানে চলে গিয়েছে প্রকৃত ছাত্রদের নাগালের বাইরে। ছাত্র সংগঠনগুলো শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের থেকে দলীয় লেজুরবৃত্তি, দলীয় কর্মসূচি ও এজেন্ডা বাস্তবায়ন, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড এবং নিজেদের সম্পদ বৃদ্ধির কাজেই বেশি ব্যস্ত থাকে।

ছাত্ররাজনীতি বন্ধের আলোচনা অনেক দিন ধরে থাকলেও সাম্প্রতিক সময়ে তা আবার জোড়ালো ভাবে আলোচিত হচ্ছে। বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতির সুবিশাল ইতিহাস রয়েছে। ভাষা রাষ্ট্রীয় অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন থেকে শুরু স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা, নব্বইয়ের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন থেকে ২০২৪ সালের বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন ও স্বৈরাচার পতন হয়েছে মূলত ছাত্রদের হাত ধরেই। তাই, ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করা কোন সমাধান হতে পারে না। কিন্তু বর্তমান অবস্থা থেকে উত্তরণ হওয়াও অত্যন্ত জরুরী। এ রকম পরিস্থিতিতে প্রয়োজন ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতির প্রেক্ষাপট পরিবর্তন।

বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও কিন্তু ছাত্ররাজনীতি রয়েছে। কিন্তু সে সকল সংগঠন সে দেশের কোন রাজনৈতিক দলের অঙ্গ বা সহযোগী সংগঠন নয় বা দলের লেজুড়বৃত্তি করে না। তারা কোন রাজনৈতিক দলের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করে না। তারা প্রকৃতই শিক্ষার্থীদের স্বার্থ রক্ষার ক্ষেত্রে কাজ করে। শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান ও অধিকার বাস্তবায়নে কাজ করে থাকে। এ সকল বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে ছাত্র সংসদও আছে, সেখানে নির্বাচনও হয়। কিন্তু এসব নির্বাচন হয় নির্দলীয় বা অদলীয় ভাবে। ঐ দেশের রাজনৈতিক দলগুলো সেখানে কোন প্রভাব বিস্তার করে না।

যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের নির্বাচিত সভাপতি ছিলেন আনিশা ফারুক নামে একজন বাংলাদেশি শিক্ষার্থী। এর আগে ১৯৯৩ সালে প্রথম জাতিগত সংখ্যালঘু হিসাবে আকাশ মহারাজা সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন এবং ১৯৯৪ সালে ছাত্র ইউনিয়নের ক্ষমতা খর্ব করার বিলের বিরুদ্ধে প্রচারভিযান চালিয়ে সফল হয়েছিলেন। অক্সফোর্ড ছাত্র সংসদ শুধুমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা নীতি নির্ধারণ ও দাবি-দাওয়া নিয়ে কাজ করার পাশাপাশি জাতীয় শিক্ষা কারিকুলাম ও উচ্চশিক্ষায় সরকারের নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রেও কাজ করে থাকে।

পরিবর্তনের আকাঙ্খায় নতুন বাংলাদেশ। তাই, সময় এসেছে বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতির গুণগত পরিবর্তনের। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র- শিক্ষক রাজনীতি দলীয় লেজুরবৃত্তির শৃঙ্খল থেকে বেরিয়ে এসে অদলীয় ধারায় বিকশিত হোক। ছাত্র রাজনীতি হোক শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের জন্য আর শিক্ষক রাজনীতি হোক শিক্ষকদের কল্যাণে, শিক্ষার মান উন্নয়নে।

তাই, শিক্ষাঙ্গনে ছাত্র রাজনীতি নয়, নিষিদ্ধ করতে হবে দলীয় লেজুরবৃত্তিকে। ছাত্র রাজনীতি হবে বিভিন্ন সংগঠনের নামে। যারা কোন রাজনৈতিক দলের অংশ হবে না। কোন রাজনৈতিক দলের প্রচার- প্রচারণা কিংবা এজেন্ডা বাস্তবায়ন শিক্ষাঙ্গনে করতে পারবে না কোন সংগঠন। যারা করবে তাদের নিষিদ্ধ করে হবে। ছাত্র সংগঠনগুলো কাজ করবে শিক্ষার্থীদের ন্যায্য দাবী আদায়ে। নিকট অতীতে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভ্যাট প্রত্যাহার আন্দোলন, নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, কোটা সংস্কার আন্দোলন এবং সর্বশেষ বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন শিক্ষার্থীদের প্রকৃত অধিকার আদায়ের আন্দোলনের উৎকৃষ্ট উদাহরণ।

দলীয় লেজুড়বৃত্তির বাইরে গিয়ে দেশের শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক বিষয়ে অংশগ্রহণের যে আকাঙ্খা সাম্প্রতিক গণঅভ্যুথানের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পেয়েছে তা ধরে রাখা অতি জরুরী। তাই, সম্ভাব্য দ্রুত সময়ে দেশের সকল সরকারি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র সংসদ/ ছাত্র কাউন্সিলে অদলীয়/নির্দলীয় নির্বাচন হওয়া প্রয়োজন। যাতে এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা অদলীয় রাজনীতি সচেতন শিক্ষার্থীদের একটা প্রাতিষ্ঠানিক রুপ দেওয়া যায় এবং দেশের নেতৃত্ব গড়ে তোলা যায়।

কোনো অবস্থাতেই ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের মতো আত্মঘাতি সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে না। কেননা মানুষ মাত্রই রাজনৈতিক জীব। রাজনীতির বাইরে কোনো মানুষ পাওয়া যাবে না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে আগামী দিনের নেতৃত্ব তৈরির পথকে রুদ্ধ করার ষড়যন্ত্রের বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।

পরিশেষে, সাম্প্রতিক গণ অভ্যুথানের সকল শহীদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও তাদের আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করে দেশের সকলের প্রতি আহ্বান, আসুন নিজে পরিবর্তন হই, দেশকে পরিবর্তন করি।

 

উন্নয়নকর্মী ও প্রকাশক

সংগঠক, অদলীয় রাজনৈতিক সামাজিক মঞ্চ

shajnush.titon@gmail.com

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button