বিশ্লেষণযুক্তি-তর্কশিক্ষা
ট্রেন্ডিং

মনোজগতে উপনিবেশ

বৃটিশ শাসনামলের মধ্যদিয়েই এই উপমহাদেশে ঔপনিবেশিকতার গোড়াপত্তন ঘটে। নানা প্রাকৃতিক ও ভূ-তাত্তিক সম্পদের কারণে এই উপমহাদেশ ব্যবসা-বাণিজ্যের অনুকূল ছিলো। আর তাই, ব্যবসা-বাণিজ্যের বিস্তার এবং এর রক্ষণাবেক্ষণের লক্ষ্যে বৃটিশরা ভারতবর্ষে একটি ভিন্ন রাষ্ট্রীয় এবং শিক্ষা ব্যবস্থাপনার প্রচলন করে।

ঔপনিবেশিক এই শিক্ষা ব্যবস্থার উদ্যেশ্য ছিলো, এই দেশের ভেতরেই এমন এক শ্রেণী তৈরী করা যারা চেহারা, রক্তে ও বর্ণে হবে খাঁটি ভারতীয় কিন্তু চিন্তা, মেধা এবং জ্ঞানে হবে বৃটিশদের দালাল। চাকুরে মানসিকতার শিক্ষিত হওয়া এই শ্রেণীটির একমাত্র কাজই হবে বৃটিশদের চাকর হওয়া। শিক্ষিত চাকর।

রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার রুপরেখাটি ছিলো বৃটিশদের শোষণের অন্যতম হাতিয়ার। এই ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বৃটিশরা হন শাসনকর্তা এবং গোটা ভারতবর্ষ তাদের অধীনস্থ প্রজাশ্রেণী। ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থার ভেতর দিয়ে বের হয়ে আসা শিক্ষিত চাকুরে শ্রেণীটি বৃটিশরাজের বহুমুখি দাপ্তরিক কাজে নিয়োগপ্রাপ্ত হন।

তৎকালীন নানা আন্দোলন সংগ্রামের মাধ্যমে বৃটিশ রাজত্বের অবসান ঘটে। ভারত ভাগের মধ্য দিয়ে বাংলা নামের এই জনপদটি পাকিস্তানের অংশ হয়ে যায়, নাম হয় পূর্ব পাকিস্তান। সেই একই ঔপনিবেশিক আইন, রাষ্ট্রীয় ও শিক্ষা ব্যবস্থা বলবত রেখে পাকিস্তানীরাও বৃটিশদের মতই শাসন শোষণ নীপিড়ন করতে থাকে। অবশেষে ১৯৭১ সালের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ আত্মপ্রকাশ করে।

আরো পড়ুন

একটি জাতি-রাষ্ট্রের জন্ম হল, নাম হলো মানচিত্র হলো, হলো না শুধু সেই বৃটিশদের রেখে যাওয়া আইন কানুন, রাষ্ট্রীয় ও শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন। আমরা স্বাধীন দেশ পেলাম কিন্তু স্বাধীন দেশউপযোগী, রাষ্ট্রীয় ও শিক্ষাব্যবস্থা পেলাম না। আর তাই একদিকে রাষ্ট্রযন্ত্রের সাথে সাধারণ জনগণের সম্পর্ক সেই বৃটিশ পাকিস্তানী শাসনামলের মতই রয়ে গেছে, অন্যদিকে সুদীর্ঘ সময় ধরে বয়ে চলা ঔপনিবেশকতার জীবানু সমাজের শিরা উপশিরা হয়ে প্রবেশ করেছে মনোজগতে।

মনোজগতে উপনিবেশ মানে হলো মনের জগত বা চিন্তার জগত দখল হয়ে যাওয়া। একটা জাতির চিন্তার জগত বেদখল হয়ে যাওয়ার পরিনাম ভয়াবহ। সম্মিলিত এই ঔপনিবেশিক মানসিকতা নিজস্ব ভাষা সংস্কৃতির জন্য হুমকির কারণ হয়ে দাড়ায়।

কিছুদিন আগে, ভারতীয় কোন এক টিভি সাংবাদিক বাংলাদেশের নামকরা কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বাঙালী ছাত্র ছাত্রীদের কিছু প্রশ্ন করেছিলেন যার জবাব তারা হিন্দীতে দিয়েছিলো। এমনকি আমাদের একজন মন্ত্রীকেও বেশ সাবলীল হিন্দীতে সাক্ষাতকার দিতে দেখা যায়। বিষয়টি হাস্যকর কিন্তু ভয়ংকর। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা খেলাচ্ছলে হিন্দী বলছে, মা বাবা খুশি হচ্ছে।

বাচ্চার এই অসাধারণ প্রতিভা বাসায় মেহমান এলে  তাদের দেখানো হচ্ছে, হাততালি দেয়া হচ্ছে। বাঙালীর উৎসবকে এখন উৎসব বলা হয় না, এর নাম এখন ফেস্ট। লোকসংগীত উৎসব-ফোক ফেস্ট, সাংস্কতিক উৎসব-কালচারাল ফেস্ট এমনকি সাহিত্য উৎসব হয়ে গেছে লিট ফেস্ট।

সবস্তরে বাংলাভাষা প্রচলনের দাবী থেকেই ২১ শে ফেব্রুয়ারীর জন্ম। এই দিনটি পৃথিবীময় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে বিনম্র শ্রদ্ধায় পালিত হচ্ছে প্রতিবছর। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। বাংলাভাষা এবং সংস্কৃতিকে প্রতিনিয়ত বিকৃত করা হচ্ছে। সেটা অন্য কেউ করছে না, করছি আমরাই। মনোজগতে ঔপনিবেশিকতার দরুন সেই বিকৃতি আমাদের চোখে পড়ছে না, আমাদের চিন্তার জগত দখল হয়ে গেছে।

বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি আমাদের সম্পদ, আমাদের পরিচয়। যে ভাষা সংস্কৃতির দাবিতে রাজপথে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিলো এদেশের আপামর জনগণ, আমাদের বুকে তাদের রক্তই বইছে। সুতরাং, একে রক্ষা করা, যত্ন করা আর বিকশিত করার দায়িত্ব আমাদেরকেই নিতে হবে।

নিজস্ব ভাষা সংস্কৃতি সমুন্নত রাখতে, মনোজগত উপনিবেশবাদ মুক্ত করতে এবং স্বাধীন দেশোপযোগী রাষ্ট্রীয় ও শিক্ষা ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে প্রত্যেক শ্রেণী-পেশার মানুষের সম্মিলিত মেধাবৃত্তিক চচা এবং ঐক্যবদ্ধ সামাজিক আন্দোলন একান্ত প্রয়োজন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button