
আমেরিকানরা নিজেদের ইতিহাস নিয়ে যেমন গর্ববোধ করে, তেমনই তাদের ইতিহাসের বিতর্কিত অধ্যায় গুলো নিয়েও সোচ্চার থাকে। এতে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, আইনগত কিংবা রাজনৈতিক বিশেষ কোনো চাপ অনুভব করতে হয় না।
রেড ইন্ডিয়ানদের গণহত্যা, কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি অবিচার, ভিয়েতনাম যুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘন, ইরাক অভিযান- এ সব কিছু নিয়েই তারা সমালোচনা করতে পারে। একই ভাবেই ঔপনিবেশিক (Colonial) শাসন-শোষণের গঠনমূলক সমালোচনা করার সুযোগ প্রায় সব ইউরোপীয় দেশেই আছে।
একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রামের মাহাত্ম নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। একটি বিশাল জনগোষ্ঠী নিজেদের হাতে অস্ত্র তুলে নিলে সবাই যে ‘দুধে ধোয়া তুলসীপাতা’র ন্যায় আচরণ করে না, এই বাস্তবতা আমাদের মাথায় রাখতে হবে।
আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বিভিন্ন গবেষণাপত্রে (Academic Study) একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণকারীদের একাংশের যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ সুস্পষ্টভাবে উঠে এসেছে। যার মধ্যে জাহানারা ইমামের ছেলে রুমি ও তার দলবল এবং আবদুল কাদের সিদ্দিকী ও তার বাহিনী অন্যতম।
পাকিস্তান সমর্থনের অভিযোগে প্রকাশ্যে বিদেশি গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে দুইজনকে বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করেন কাদের সিদ্দিকী। শর্মিলা বসুর ডেড রেকোনিং বইয়ে খুলনায় তৎকালীন পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসের কর্মকর্তাকে জবাই করে হত্যার পর তার মাথা নিয়ে উল্লাসের কথা ছবিসহ উল্লেখ আছে। কিশোর আলোতে একটি সাক্ষাৎকার ছাপানো হয়, যেখানে রুমির নানান যুদ্ধাপরাধমূলক কাজের কথা উঠে এসেছে।
মুক্তিযুদ্ধের অতিরিক্ত স্তুতির (Over Glorification) কারণেই গত ৫৩ বছর, বিশেষ করে গত ১৬ বছর ধরে স্বাধীনতার স্বপক্ষ শক্তি আর বিপক্ষ শক্তি- এই দুই ভেদাভেদ এবং তার ফলশ্রুতিতে যাকে তাকে হেনস্থা করার অসংখ্য উদাহরণ আমরা দেখেছি।
সবচেয়ে দুঃখজনক সম্ভবত যুদ্ধ চলাকালীন ও যুদ্ধপরবর্তী বিহারী হত্যা এবং ৫৩ বছর ধরে তাদের প্রতি নানান রকম বৈষম্য।
‘জামাত স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরোধিতা করেছিলো’-এই কথা বলে ঢালাও ভাবে দাঁড়ি টুপি মাত্রই রাজাকার গণ্য করার প্রবণতাকেও (যা নাটক সিনেমাতে প্রচুর লক্ষ্য করা যায়) আমি এই মুক্তিযুদ্ধের অতিরিক্ত স্তুতির (Over Glorification) ফলাফল হিসাবেই মনে করি।
কখনো কি এভাবে ভেবে দেখেছি আমরা, ১৯৩০/৪০ সালের দিকে যারা নিজে ব্রিটিশ বিরোধী এবং পাকিস্তান আন্দোলনে শরীক হয়েছেন এবং যারা নিজেদের বাবা, বড় ভাইদের সক্রিয় ভাবে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন করতে দেখেছেন, তাদের কাছে তো তৎকালীন পাকিস্তানের প্রতি ভালোবাসা আমাদের মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীতে বাংলাদেশের প্রতি ভালোবাসার মতই নয় কী? যেই পাকিস্তানের জন্য তারা লড়াই করেছেন/ আপনজনদের লড়াই করতে দেখেছেন, সেই পাকিস্তান ভাগ না হোক এটা চাওয়া কি তাদের জন্য বিরাট কোনো অপরাধ?
যদি সাধারণ নাগরিক (civilian) হত্যা বা এই ধরণের কোনো যুদ্ধাপরাধ করে থাকে, তাহলে নির্দ্বিধায় তা শাস্তিযোগ্য। কিন্তু কেবলমাত্র অবিভক্ত পাকিস্তান চাওয়া এবং সেই চাওয়ার পক্ষে অবস্থান জানানো কখনোই যুদ্ধাপরাধ হতে পারে না।
অপরদিকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান অবশ্যই মহান এবং প্রশংসনীয়। কিন্তু সেই মুক্তিযুদ্ধের নামে নিরস্ত্র সাধারণ নাগরিক (civilian) হত্যা, লুটপাট ইত্যাদি সজ্ঞানুযায়ী (by definition) এ ধরণের ঘটনা যুদ্ধাপরাধের মধ্যেই পড়ে।
যেখানে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তি দাবি করে জামাত-শিবিরের ১৪ গুষ্টি আমরা উদ্ধার করি, সেখানে বিহারী হত্যা নিয়ে টু শব্দটাও করি না! স্বপরিবারে জবাই হওয়া বিহারীদের লাশ দেখে (যেখানে ছোট্ট শিশু ও ছিল) জাফর ইকবাল কতটা সাবলীল ভঙ্গিতে তার লেখায় লিখে গেছেন যে, এর মাধ্যমে তারা নাকি তাদের মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থানের চরম মূল্য দিচ্ছে! সেই শিশুটিও কি যুদ্ধাপরাধী ছিল? তার হত্যাকারীই আমাদের জাতীয় বীর?!
আমি মনে করি, জাতি হিসাবে আমাদের দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে। একাত্তরের অর্জনের গর্ব যেমন আমাদের অধিকার, একাত্তরের ব্যর্থতার স্বীকারোক্তি আমাদের দায়িত্ব। নিজেদের সীমাবদ্ধতা স্বীকার করে সব ধরণের যুদ্ধাপরাধের সুষ্ঠু বিচার করে সকল ভুক্তভোগীর (victim) প্রতি ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
(শিক্ষার্থী, সাংবাদিকতা বিভাগ, নর্থওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটি)