
ভারতের আদানি গ্রুপের কাছ থেকে বিদ্যুৎ কেনার চুক্তি নিয়ে উচ্চ পর্যায়ের তদন্তের প্রেক্ষাপটে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বড় অংকের শুল্ক ও কর আদায় না হওয়ার অভিযোগের মুখে পড়েছে। আদানি গ্রুপের সঙ্গে এই চুক্তির বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন দায়ের করেছেন সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী এম আব্দুল কাইয়ুম। বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর হাইকোর্ট বেঞ্চে রিটটির শুনানি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
তদন্তের অংশ হিসেবে, শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর ৫ সেপ্টেম্বর আদানি গ্রুপের সঙ্গে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) চুক্তি খতিয়ে দেখার জন্য ৯ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে। এই কমিটির কাজ ছিল আদানি গ্রুপের কাছ থেকে বিদ্যুৎ আমদানি করার ক্ষেত্রে নির্ধারিত মূল্য এবং এর ওপর শুল্ক-কর আদায়যোগ্য কিনা তা পর্যালোচনা করা। কমিটি একইসঙ্গে যাচাই করেছে শুল্ক-কর অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল কিনা এবং যদি দেওয়া হয়ে থাকে, সেটি এনবিআরের অনুমোদনক্রমে হয়েছে কিনা। ৩ নভেম্বর কমিটি তাদের তদন্ত প্রতিবেদন এনবিআরে জমা দেয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এনবিআর থেকে শুল্ক-কর অব্যাহতির অনুমতি না থাকা সত্ত্বেও আদানি গ্রুপ থেকে বিদ্যুৎ আমদানি করে পিডিবি কর্তৃক শুল্ক-কর পরিশোধ করা হয়নি। ফলে ৩৯ কোটি ৭৩ লাখ ডলার (প্রায় ৪ হাজার ৬৮৮ কোটি টাকা) আদায়যোগ্য। এই পরিমাণ অর্থ পিডিবি থেকে এনবিআরের কাছে জমা হওয়ার কথা ছিল, যা না হওয়ার কারণে রাষ্ট্র উল্লেখযোগ্য শুল্ক রাজস্বের ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে যে, আদানির সঙ্গে এই চুক্তির আগে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ বিভাগ ভারতের এনটিপিসি বিদ্যুৎ নিগাম লিমিটেড থেকে বিদ্যুৎ কিনতো। তখনও এনবিআর থেকে শুল্ক-কর মওকুফের আদেশ জারি করা হয়নি। এ কারণে এনটিপিসি থেকে বিদ্যুৎ কেনার ক্ষেত্রেও বিদ্যুৎ বিভাগ শুল্ক-কর ফাঁকির দায় এড়াতে পারে না। এই অবস্থায় বিদ্যুৎ বিভাগকে শুল্ক-কর পরিশোধের নির্দেশনা দেওয়া উচিত বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১৭ সালের ৫ নভেম্বর আদানি পাওয়ারের সঙ্গে বিদ্যুৎ ক্রয়ের চুক্তি সই করে পিডিবি। প্রায় ১,৪৯৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেনার চুক্তিটি সম্পন্ন হয় অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে। এই চুক্তির খসড়া কোনো দপ্তরে মতামতের জন্য পাঠানো হয়নি। এমনকি বিদ্যুৎ বিভাগে এলেও তা পিডিবিতে পাঠানো হয়নি। ফলে চুক্তির ধারা ও শর্তাবলি সম্পর্কে বিদ্যুৎ খাত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা কিছুই জানতেন না। চুক্তির প্রক্রিয়া তদারকি করেন তৎকালীন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সচিব ড. আহমেদ কায়কাউস।
এনবিআরের একজন কর্মকর্তা জানান, ২০২২ সালে বিদ্যুৎ আমদানিতে শুল্ক-কর মওকুফের জন্য বিদ্যুৎ বিভাগ এনবিআরের কাছে চিঠি দেয়। এই চিঠির প্রেক্ষিতে এনবিআর বিদ্যুৎ বিভাগকে চুক্তির খসড়া পাঠানোর জন্য ২০২৩ সালে তিনবার চিঠি পাঠায়, তবে বিদ্যুৎ বিভাগ খসড়া পাঠায়নি। ৩১ অক্টোবর বিদ্যুৎ বিভাগ জানায় যে, এনবিআরের নির্দেশনা অনুযায়ী ‘যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদনক্রমে’ শুল্ক ও কর ছাড়ের ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
তদন্ত কমিটির একজন কর্মকর্তা জানান, আদানির সঙ্গে চুক্তির শর্তানুসারে, আমদানির পর্যায়ে আদানি যাবতীয় শুল্ক ও কর মওকুফের সুবিধা পাবে। তবে মওকুফ সংক্রান্ত আদেশ পিডিবির মাধ্যমেই অনুমোদিত হতে হবে এবং শুল্ক-কর বকেয়া হলে নির্ধারিত সময়ে তা পরিশোধ করার দায়িত্বও পিডিবির।
কাস্টমস আইন অনুযায়ী, পণ্য আমদানির আগে কাস্টমস স্টেশনে বিল অব এন্ট্রি জমা দিতে হয়। তবে কাস্টমসের অ্যাসাইকুডা সফটওয়্যারে আদানির বিদ্যুৎ আমদানির কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি, যা শুল্ক গোয়েন্দার প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
এনবিআরের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এই বিষয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে তা এনবিআর সিদ্ধান্ত নেবে।