খবরাখবরশিল্প-সাহিত্য
ট্রেন্ডিং

চলচ্চিত্রে রাজনীতি

চলচ্চিত্রের সুচনালগ্ন থেকেই একে বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে দেখা হতো। কিন্তু চলচ্চিত্র এখন আর কেবল বিনোদনে সীমাবদ্ধ নেই। বরং আর্থসামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে প্রতিনিয়তই মানুষের জীবন সম্পর্কে নতুন করে ভাবার রসদ জোগাচ্ছে। যা পরিবর্তন আনার ক্ষেত্রে খুবই শক্তিশালী ভূমিকা পালন করে।

একেবারে শুরুর দিকে সাধারণ মানুষ চলচ্চিত্র দেখে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকতো। এর মধ্যে তারা নিজেদের আরেক জীবন দেখতে পেতো। সেই লুই লুমিয়ের থেকে শুরু করে পরবর্তীতে জর্জ মিলিয়ে ও গ্রিফিথ নানাভাবে চলচ্চিত্রকে ব্যবহার করেছেন। কিন্তু সবকিছুকে ছাপিয়ে চলচ্চিত্র হয়ে উঠলো একটি গণমাধ্যম। চলচ্চিত্রকাররা দেখলেন এটি গণমানুষের কথা বলে। পরবর্তীতে এটি রাজনৈতিক ও সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির জন্যও ব্যবহার করা শুরু হয়।

প্রথমে গ্রিফিথ নির্মাণ করেছিলেন পূর্ণদৈর্ঘ্য নির্বাক চলচ্চিত্র “বার্থ অব এ নেশন”। এ ছবিতে তৎকালীণ আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জন আব্রাহামের নিহত হওয়ার ঘটনা দেখানো হয়। তুলে ধরা হয় শ্বেতাঙ্গদের কাছ থেকে কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম। এর মাধ্যমে তৎকালীণ রাজনৈতিক বাস্তবতা ফুটে ওঠে।
ফলে এই সিনেমাটি রাজনৈতিক প্রপাগান্ডা হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে।

এমনকি ১৯১৭ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নে সংগঠিত সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট লেনিন চলচ্চিত্রকে ব্যবহার করেন। যার প্রেক্ষাপট ছিলো এইরকম, ১৯০৬ সালে রাশিয়ার ওডেসা বন্দরে অবস্থিত যুদ্ধজাহাজ পোটেমকিনের নৌসেনারা তৎকালীন জারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে এবং জাহাজটিকে নিয়ে কৃষ্ণ সাগরে চলে যায়। জারের অনুগত বাহিনী জাহাজটিকে অবরোধ করে। শেষ পর্যন্ত রসদ ফুরিয়ে গেলে ক্ষুধায়-তৃষ্ণায় কাতর বিদ্রোহী সৈন্যরা আত্মসমর্পন করে। এই নৌবিদ্রোহ ব্যর্থ হলেও লেনিন এর প্রসংসা করেন এবং এই ঘটনাকে ১৯১৭ সালের কমিউনিস্ট বিপ্লবের সূচনা বলে অভিহিত করেন। তখন মন্তাজ তত্ত্বের প্রবক্তা সার্গেই আইজেনিস্টাইন এই বিদ্রোহের ওপর “ব্যাটেলশিপ পোটেমকিন” নামের চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেন। এছাড়াও তৎকালীন বিখ্যাত চলচ্চিত্রকাররা বেশ কিছু সিনেমা নির্মাণ করেন, যা দেশের সীমানা পেরিয়ে সারাবিশ্বে চলচ্চিত্রকে একটি বিপ্লবের উপকরণ হিসেবে রুপান্তরিত করে।

পরবর্তীতে কিউবাতেও বামপন্থী বিপ্লব সফল হওয়ার পর, নতুন সমাজে বৈপ্লবিক চিন্তা শক্তিশালী করতে একটি ফিল্ম ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করা হয়। যেখানে তৈরি হতে থাকে বিভিন্ন চিন্তাশীল চলচ্চিত্র।

চলচ্চিত্র একটি দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে কতটা শক্তিশালী প্রভাব রাখতে পারে, তার আরেক উজ্জল উদাহরণ হচ্ছে “দ্য ব্যাটেল অব আলজিরিয়ার্স”। সিনেমাটি নির্মাণ করেন গিল্ল পনটিয়োরভোর। এতে দেখানো হয় ১৯৫০ দশকের শেষ দিক এবং ষাট দশকের শুরুর দিকে উত্তর আফ্রিকায় ফরাসি সরকারের বিরুদ্ধে আলজেরিয়ানদের যুদ্ধ। চলচ্চিত্রটিতে আলজেরিয়ানদের পক্ষে এবং ফরাসিদের বিপক্ষে নানা ধরনের রাজনৈতিক বার্তায় পরিপূর্ণ ছিলো।

শক্তিশালী প্রতিবাদের আজও অনন্য প্রতীক হয়ে আছে ১৯৩৩ সালে নির্মিত “ডার্ক সুপ” সিনেমাটি। যুদ্ধ ও রাজনীতি নিয়ে ব্যঙ্গাত্মক চলচ্চিত্রটিতে মুসোলিনির চরম সমালোচনা করা হয়। এছাড়াও ১৯৪০ সালে চার্লি চ্যাপলিন নির্মাণ করেন “দ্য গ্রেট ডিকটেটর”। সিনেমাটিতে নাৎসীবাদী জার্মানির ফ্যাসিবাদী শাসনের ব্যাঙ্গ করা হয়। সেনেগালের বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার ওসমান সেমবেনের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ছবি, ‘হাল্লা’ (১৯৭৪) সেনেগালের স্বাধীনতা-পরবর্তী শাসকদের নির্দয় আচরণের সমালোচনা তুলে ধরে। তাই অনেক দৃশ্য বাদ দেওয়ার পরই কেবল ‘হাল্লা’ মুক্তি দিতে দেওয়া হয় সেমবেনকে।

এছাড়াও সারাবিশ্বের আলোড়ন সৃষ্টিকারী কিছু রাজনৈতিক সিনেমা হলো, ফ্রাঙ্ক চাপরার এর পরিচালিত ‘‘মিস্টার স্মিথ গৌজ টু ওয়াশিনটন’’ (১৯৩৯), নিক্সনের ওয়াটার গেইট কেলেঙ্কারীর উপর নির্মিত এলান জে পাকুলার এর ‘‘অল দ্যা প্রেসিডেন্টস্ মেন’’, এলিয়া কাজেনের ‘‘এ ফেইস ইন দ্যা ক্রাউড’’ (১৯৫৭), বৃটিশ-আমেরিকা কর্তৃক ইরাক যুদ্ধের ওপরর নির্মিত আরমান্ডো আইনভিসি’র ‘‘ইন দ্যা লুক’’ (২০০৯), অরসন ওয়েলস এর ‘‘সিটিজেন কেন’’ (১৯৪১), স্টিভেন স্পিলবাগের ‘‘লিংকন” (১৯১২), রবার্ট রোসেন এর ‘‘অল দ্যা কিংস মেন” (১৯৪৯), জন ফার্নকেইন হেইমার এর ‘‘সেভেন ডেইজ ইন মে’’ (১৯৬৪), মাইকেল কার্টেস এর ‘‘কাসাব্লাঙ্কা’’ (১৯৪২), লিনি রিফেলেস্টল এর ‘‘ট্রায়াম্ফ অব দ্যা উইল” (১৯৩৫), কাস্টা গ্রাফস এর ‘‘জেড’’ (১৯৬৯), রবার্ট উইস এর “দ্যা ডে দ্যা আর্থ স্টুড স্টিল (১৯৫১), কেন লস এর “ল্যান্ড এন্ড ফ্রিডম” (১৯৯৫), ইউরি ওজেরোভ এর “ব্যাটেল অভ মস্কো” (১৯৮৫), রেনে ভাউটিয়র এর “আফ্রিক ৫০” (১৯৫০), কার্ল ফোরম্যান এর “দ্যা ভিক্টোরস” (১৯৬৩), আলেকজান্ডার কট এর “ফর ট্রেস অব ওয়ার” (১৯১০), পল টিকেল এর “রেসিজম অফ হিস্ট্রি” (২০০৭), মাইকেল বের “পার্ল হারবার” (২০০১)।

তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে উপনিবেশিকতা-পরবর্তী সমস্যা পীড়িত পরিস্থিতিতে চলচ্চিত্রকাররা নিজেদের ছবিতে সমকালীন বাস্তুবতার মুখোমুখি হয়েছেন। বর্তমানের সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যার সমালোচনা কখনও তাঁরা তুলে ধরেছেন সরাসরিভাবে, আবার কখনো সমালোচনা করা হয়েছে রূপকের মাধ্যমে।
উপসমহাদেশের প্রথম রাজনৈতিক চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন হীরালাল সেন। ১৯০৫ সালে নির্মিত এই ছবির নাম “এন্টি পার্টিশন এন্ড স্বদেশী মুভমেন্ট”। সিনেমাটি বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের ওপর নির্মিত।

পাকিস্তান-ভারতের বিরোধসহ ভূ-রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সীমান্ত বিরোধের বিষয়গুলো নিয়ে ভারত-পাস্তিান উভয় দেশই অনেক চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছে।

ঋত্বিক ঘটকও দেশ বিভাগ ও উপমহাদেশের রাজনীতি নিয়ে ছবি বানিয়েছেন। তার অন্যতম হচ্ছে, “মেঘে ঢাকা তারা” (১৯৬০), কোমল গান্ধার” (১৯৬১), “সুবর্ণ রেখা” (১৯৬২)।

“মেঘে ঢাকা তারা” ছবিতে তিনি দেখান পূর্ব বাংলা থেকে চলে যাওয়া বাস্তুহারা এক স্কুল মাস্টার ও তার পরিবারের ঠাঁই হয় কলকাতার বস্তিসম এক জায়গায়। এখানে কলকাতার তৎকালীন অবস্থা এবং উদ্বাস্তু পরিবারের অসহাত্ব তুলে ধরা হয়েছে।

“কোমল গান্ধার” ছবিতে তিনি দেখান পশ্চিমবঙ্গের স্থায়ী এবং উদ্বাস্তুদের নিয়ে গড় ওঠা নাটকের দলের গল্প। নাটকের দলের মাঝে বিভাজন, দল ভাঙ্গা এবং কারো কারো চলে যাওয়া, বাংলা ভাগ এবং আত্মীয় বিচ্ছেদের বিষয়গুলো।

“সুবর্ণ রেখা” ছবিতে পূর্ব বাংলার বাস্তুহীন বাগদী বউ এবং তার ছেলের রিফিউজি ক্যাম্প থেকে আলাদা হয়ে যাওয়া। শিশু সন্তানের কাছ থেকে মাকে আলাদা করা। সিনেমাটিতে যেন প্রশ্ন ছুড়ে দেওয়া হয়েছে, যে কেউ কি জানবে এই উদ্বাস্তু দুই প্রজন্মের দুইজন কোথায় গিয়ে দাড়াবে?

এছাড়াও ঋত্বিক ঘটকের প্রতিটি ছবিতেই দেশ ভাগ উপমহাদেশের রাজনীতির কথা উঠে এসেছে।

বুদ্ধদেব দাস গুপ্ত নির্মাণ করেন “তাহাদের কথা” (১৯৯২)। এখানে তিনি দেখান দেশ ভাগের পর পূর্ব বাংলার একজন বিপ্লবীর মনোবৈকল্যের চিত্র। সিনেমার নায়ক শিবনাথ জেল থেকে ফেরার পর স্ত্রী, কন্যা, পুত্রের সাথে দেখা হয় নতুন দেশে। সেই নতুন দেশের নাম ভারত। মাথা গোজার ঠাঁই ও সরকারি সাহায্যে কোনোমতে তাদের জীবন চলতে থাকে। পরিবারের সাথে তাল মেলাতে পারে না শিবনাথ। পারে না সমাজের আরো অনেক কিছুর সাথে।

সাম্প্রতিক কালে নির্মিত রাজনৈতিক চলচ্চিত্র “শঙ্কচিল”। এ ছবিতে মূলত দেশভাগের ফলে একই ভাষা ও সংস্কৃতির দু’পাশের মানুষের মানবিক দিক ছাড়াও চরম সত্য রাজনৈতিক বৈষম্যের বিষয় উঠে এসেছে।

দেশ ভাগ ও উপমহাদেশের রাজনীতি নিয়ে আরো অনেকেই ছবি নির্মাণ করেছেন। নিমাই ঘোষের “ছিন্নমূল” (১৯৫০), সলিল সেনের “নতুন ইহুদি” (১৯৫১), শান্তিপ্রিয় মুখার্জীর “রিফিউজি” (১৯৫৯), বিমল বসুর “নবরাগ” (১৯৭০), রাজেন তরফদারের “পালঙ্ক”, গৌতম ঘোষের “দেখা” (২০০১), তানভির মোকাম্মেলের “চিত্রা নদীর পাড়ে” (১৯৯৮), মৃণাল সেনের “পদাতিক” (১৯৭৩), “আকালের সন্ধানে” (১৯৮০), “নীল আকাশের নিচে (১৯৫৯) অন্যতম।

বাঙলায়ও নির্মিত হয়েছে অনেক রাজনৈতিক চলচ্চিত্র। আশির দশকে তৎকালীন রাজনৈতিক বাস্তবতার উপর সত্যজিৎ রায় নির্মাণ করেছিলেন বহুল আলোচিত ‘হীরক রাজার দেশে’। ভারতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলা হলেও সত্তরের দশকে সেখানে মানুষ দেখতে পেয়েছে রাজনৈতিক পীড়ন আর জরুরি অবস্থা। এই পরিস্থিতিতে নিজ ছবিতে সত্যজিৎ ব্যাঙ্গ করে শাসকদের আচরণের অসঙ্গতি ও সমাজে টিকে থাকা অন্যায় তীব্রভাবে আক্রমণ করেছেন। এমন রাজনৈতিক সমালোচনার উদ্দেশ্য ছিল দর্শককে বর্তমান ব্যবস্থার প্রকৃত রূপ সম্পর্কে সচেতন করে তোলা। এছাড়া তার নির্মিত গুপী-বাঘার গানও হালকা বিনোদন যোগায় না, বরং সেখানে আমরা শুনি পরিচালকের রাজনৈতিক বক্তব্য। হাস্যরসের মাধ্যমেই শেষ দৃশ্যে দেখানো হয় অত্যাচারী রাজার পতন।

ষাটের দশকে বৈষম্য আর শোষণের বিরুদ্ধে বাঙালিদের প্রতিবাদের ফলে যে রাজনৈতিক অস্থিরতার সৃষ্টি হয়েছিল সেটি তুলে ধরার চেষ্টা তৎকালীন বাংলা চলচ্চিত্রে দেখা যায়নি। হয়তো স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের নিয়ন্ত্রণের কথা চিন্তা করেই চলচ্চিত্রকাররা এতে অনাগ্রহী ছিলেন। তখন সমকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের সাহসী সমালোচনা তুলে ধরা হয়েছিল একমাত্র ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবিতেই।

জীবন থেকে নেয়া (১৯৭০) নির্মাণের সময় জহির রায়হানকে বারবার পাকিস্তুানি সামরিক প্রশাসনের অসন্তোষ আর ক্রোধ মোকাবেলা করতে হয়েছিল। রূপকধর্মী কাহিনীর মাধ্যমে পরিচালক, শাসকগোষ্ঠীর স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাবের সমালোচনা তুলে ধরেন। তা সত্ত্বেও সরকারি নির্দেশে ছবি থেকে বিভিন্ন দৃশ্য তাঁকে বাদ দিতে হয়।

তৎকালীন সারা পাকিস্তানের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে (১৯৪৭-১৯৭০) জীবন থেকে নেয়াই একমাত্র ব্যতিক্রমী চলচ্চিত্র, যাতে একটি পারিবারিক কাহিনী নির্ভর মেলোড্রামার আড়ালে সমকালীন রাজনীতি, গণ-আন্দোলন, ছাত্র-আন্দোলন, পুলিশি নির্যাতনের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের প্রতিবাদ, একনায়কতন্ত্র সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র ও মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই, বাঙালি জাতীয়তাবাদ ইত্যাদি প্রসঙ্গ স্থান পেয়েছে। এই চলচ্চিত্রেই প্রথমবারের মতো তুলে ধরা হয়েছে মহান একুশে ফেব্রুয়ারির চেতনা, নগ্নপদে প্রভাতফেরি-মিছিল, পোস্টার-ফেস্টুন-ব্যানারসহ শহীদ মিনারে ফুলেল শ্রদ্ধার্ঘ্য প্রদান ও সমবেত কণ্ঠে অমর একুশের গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’।

“স্টপজনেোসাইড” শুধু এদেশের মানুষের জন্য নয়, ছবিটি বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের চেতনার প্রতীক এবং আমাদের মুক্তিযুদ্ধের একটি বিশ্বস্ত দলিল। এ ছবির মধ্য দিয়ে জহির রায়হান বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সামনে রেখে গোটা বিশ্বে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি দেখিয়েছেন। তিনটি দৃশ্যের মধ্য দিয়ে তিনি এই এই বিষয়টি তুলে ধরেন। প্রথম দৃশ্যে দেখা যায় নিউ ইয়র্কের জাতিসংঙ্ঘের সদর দফতরে বিশ্ব নেতারা চমৎকার সব কথা বলছেন। পরের দৃশ্যে দেখা যায় ভিয়েতনামে বি-৫২ বোমারু বিমানের ধ্বংসযজ্ঞ। মার্কিন কর্তৃক নারী-পুরুষ ও শিশুদের হত্যা। ভিয়েতনামের যুদ্ধাপরাধের বিচারাধীন মার্কিন লেফটেনেন্ট এর পক্ষে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের সাফাই গাওয়ার দৃশ্য। ঠিক এর পরের দৃশ্যেই চলে আসে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। পর্দায় ভেসে ওঠে বুড়িগঙ্গা নদীর তীর। গ্রামীন জনপদ। ভেসে ওঠে লাশ। হত্যাযজ্ঞের সব দৃশ্য। দূরে কোথাও কাকের ডাক শোনা যায়।

তারেক মাসুদ যখন ধর্মীয় গোঁড়ামি, মৌলবাদ ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের ব্যবহারের সমালোচনা করে ‘মাটির ময়না’ (২০০২) নির্মাণ করেন, তখন এমন বিষয়বস্তুকে স্পর্শকাতর আখ্যা দিয়ে ছবিটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। ছবিটিতে পরিবর্তন আনতেও বলা হয় নির্মাতাকে। এরপর ছবিটির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হলেও সিনেমা হলগুলোতে যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে প্রদর্শনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এই ঘটনাসমূহ নির্দেশ করে, সমাজের নেতিবাচক দিকের সমালোচনা চলচ্চিত্রে প্রকাশের কাজটি ঝুঁকিপূর্ণ ও কঠিন। তবে সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটক, ওসমান সেমবেন, জহির রায়হান, তারেক মাসুদ এবং বিভিন্ন দেশে আরও অনেক চলচ্চিত্রকার এমন ঝুঁকির মধ্যেই কাজ করেছেন।

একটি গণযুদ্ধের মধ্য দিয়েই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। তাই স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে প্রয়োজন ছিল বিদেশি শাসকগোষ্ঠীর সৃষ্ট সমাজকাঠামো বদলিয়ে নিজস্বতার আলোকে স্বাধীন দেশের আশা আকাঙ্খার প্রতিফলন ঘটানো। স্বাধীন সমাজে নতুন চিন্তা প্রতিষ্ঠিত করার জন্য শিল্পকলার বিভিন্ন শাখা বিশেষ করে চলচ্চিত্রও ভিন্ন পদ্ধতিতে ব্যবহার করা জরুরি ছিল। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, যে অল্পসংখ্যক চলচ্চিত্রে প্রথাবিরোধী চলচ্চিত্র-ভাষা ব্যবহার এবং রাজনৈতিক বক্তব্য প্রদানের চেষ্টা করা হয়েছে, সেখানেও প্রায়ই সমকালীন সময় সরাসরি তুলে ধরা হয়নি। সেখানে রাজনৈতিক সমালোচনা প্রকাশিত হয়েছে পরোক্ষভাবে, অতীতের কোনো সময় তুলে ধরার মধ্য দিয়ে।

যেমন, স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের সমালোচনা করলেও আলমগীর কবিরের ‘রূপালী সৈকতে’ (১৯৭৯) ছবিটিতে কাহিনির সময়কাল ষাটের দশকের পূর্ব পাকিস্তুান, ১৯৭০এর বাংলাদেশ নয়। মহিউদ্দিন শাকের আর শেখ নিয়ামত আলীর ‘সূর্যদীঘল বাড়ি’ (১৯৮০) ছবির কাহিনীর পটভূমি ভারতভাগের ঠিক আগে পূর্ব বাংলার এক গ্রামের জীবনযাত্রা। এছাড়া স্বাধীন দেশে চাষী নজরুল ইসলামের “ওরা এগারোজন”, হুমায়ূন আহমেদের “আগুনের পরশমনি” মানুষকে রাজনৈতিক সচেতনতা দান করে।

সব শেষে বলতে হয়, রাজনীতিকে শুধু একটি মাত্র দিক থেকে পর্যালোচনা করা সম্ভব নয়। রাজনীতির কোন বিষয়টি চলচ্চিত্রের বিষয় হবে, সেটিও ভাববার বিষয়। রাজনীতি নিয়ে অনেক ভালো চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে, ভবিষ্যতে আরো অনেকেই নির্মাণ করবে রাজনীতি নির্ভর চলচ্চিত্র।

তাদেরই পথের দিশারী হয়ে ঋত্বিক ঘটক বলেছেন, “আমি প্রতি মুহূর্তে আপনাকে ধাক্কা দিয়ে বোঝাবো যে, ইট ইজ নট অ্যান ইমেজিনারি স্টোরি। বা আমি আপনাকে সস্তা আনন্দ দিতে আসিনি। প্রতি মুহূর্তে আপনাকে হাতুরি মেরে বোঝাবো যে, যা দেখছেন তা একটা কল্পিত ঘটনা। কিন্তু এর মধ্যে যেটা বোঝাতে চাইছি আমার সেই থিসিস টা বুঝুন। সেটা সম্পূর্ণ সত্য, সেটার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্যই আমি আপনাকে এলিনিয়েট করবো প্রতি মুহূর্তে। যদি আপনি সচেত হয়ে ওঠেন, ছবি দেখে বাইরের সেই সামাজিক বাধা দুর্নীতি বদলের কাজে লিপ্ত হয়ে ওঠেন, আমার প্রটেস্ট টাকে যতি আপনার মধ্যে চাপিয়ে দিতে পারি, তবেই শিল্পি হিসেবে আমার সার্থকতা।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button