
দুর্নীতির অভিযোগে শেষ পর্যন্ত পদত্যাগ করলেন যুক্তরাজ্যের ক্ষমতাসীন লেবার পার্টির মন্ত্রী ও শেখ রেহানার মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিক। মঙ্গলবার (১৪ জানুয়ারি) ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী স্যার কিয়ার স্টারমারের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে পদত্যাগপত্র দেন তিনি। দ্য গার্ডিয়ানসহ দেশটির গণমাধ্যমগুলোতে এ খবর ফলাও করে প্রকাশ করা হয়েছে।
টিউলিপ সিদ্দিক যুক্তরাজ্যের অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনীতিবিষয়ক মিনিস্টার (ইকোনমিক সেক্রেটারি) ছিলেন। দেশটির আর্থিক খাতে দুর্নীতি বন্ধের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। কিন্তু তার বিরুদ্ধেই লন্ডনে একাধিক ফ্ল্যাট কেলেঙ্কারির ঘটনা সামনে এসেছে, বাংলাদেশেও তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের তদন্ত চলছে।
টিউলিপ সিদ্দিক লন্ডনের ব্যবহৃত ফ্ল্যাটটি আইল্যান্ডসে নিবন্ধিত পেডরক ভেঞ্চারস নামের একটি অফশোর কোম্পানির মাধ্যমে ২০০০ সালে ২ লাখ ৪৩ হাজার পাউন্ড দিয়ে কেনা হয়। এই কোম্পানির সঙ্গে নাসিম আলী ও মাসুদ আলী নামে বাংলাদেশের দুজন ব্যবসায়ীর সংশ্লিষ্টতা রয়েছে।
দ্য সানডে টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৬ সালে ফাঁস হওয়া পানামা পেপারস এবং ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টসের (আইসিআইজে) সরবরাহ করা নথিতে দেকা যায়, হারবার্টন এস এ নামের একটি অফশোর কোম্পানি কিনে নেয় পেডরক ভেঞ্চারস, পরে পেডরক ভেঞ্চারসও বন্ধ হয়ে যায়।
তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশি নাসিম আলী ও মাসুদ আলী পেডরক ভেঞ্চারস প্রতিষ্ঠানটির মালিক ছিলেন। ১৯৮৩ সালে ঢাকায় নিবন্ধিত শ্যামলিমা লিমিটেড নামের একটি কোম্পানির যৌথ মালিক তারা। ওই প্রতিষ্ঠানটি বিদেশি জ্বালানি তেল কোম্পানিগুলোকে লোকবল সরবরাহের পাশাপাশি বাংলাদেশে বিভিন্ন ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা করে।
১৯৭০ সালে যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমান নাসিম আলী (৭০)। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টে দাখিল করা নথিতে তার ভাই মাসুদ আলী যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন। ব্যবসায়ের অংশীদার শহীদ ইনাম চৌধুরীর সঙ্গে মিলে তারা শুধু পেডরক বা হারবার্টন এস এ নয়, ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডসে আরও একাধিক প্রতিষ্ঠানে সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। এর মধ্যে একটি শ্যামলিমা লিমিটেড।
২০০৫ সালের জানুয়ারিতে নাসিম আলী ও মাসুদ আলী হারবার্টন এস এ বন্ধ করে দিতে বলেন। এর ২৪ ঘণ্টার কম সময়ের মধ্যে সেই ফ্ল্যাটের মালিকানা মঈন গনি নামের বাংলাদেশি আইনজীবীকে উপহার হিসেবে হস্তান্তর করা হয়। তিনি শেখ হাসিনা সরকারের প্রতিনিধিত্ব করেছেন, আন্তর্জাতিক একটি প্যানেলে শেখ হাসিনাই তাকে ভূমিকা রাখতে বলেছিলেন। মঈন গনির বাবা–মায়ের সঙ্গে টিউলিপ সিদ্দিকের মা শেখ রেহানার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। ২০০৯ সালের মার্চে সেই ফ্ল্যাট টিউলিপের বোন আজমিনাকে উপহার দেন মঈন গনি। আজমিনা সিদ্দিককে ফ্ল্যাটটি হস্তান্তরের নথিতে নাসিম আলীর স্বাক্ষরের সঙ্গে পানামা পেপার্সে থাকা তার স্বাক্ষরের মিল রয়েছে।
বেশ কয়েক বছর ওই ফ্ল্যাটে ছিলেন টিউলিপ সিদ্দিক। ২০১২ ও ২০১৪ সালে নিজের ঠিকানা হিসেবে ওই ফ্ল্যাট উল্লেখ করেছিলেন তিনি। টিউলিপের স্বামী ক্রিশ্চিয়ান পারসিও ২০১৬ সালে তার ঠিকানা হিসেবে ওই ফ্ল্যাটের উল্লেখ করেছিলেন। পরের বছর যুক্তরাজ্যের টিউলিপ এমপি নির্বাচিত হন। পরে তার বোন আজমিনা সিদ্দিক ওই ফ্ল্যাট ৬ লাখ ৫০ হাজার পাউন্ডে বিক্রি করেন।
বিতর্কের মধ্যেই টিউলিপের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ তদন্তের আহ্বান জানিয়েছেন বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
দ্য সানডে টাইমসকে তিনি বলেন, তদন্তে ফ্ল্যাটটি ডাকাতির মাধ্যমে টিউলিপ পেয়ে থাকার তথ্য মিললে সেটি বাংলাদেশ সরকারের কাছে ফেরত দেওয়া উচিত।
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কেয়ার স্টারমারের কাছে টিউলিপ সিদ্দিককে বরখাস্তের দাবি জানিয়েছেন দেশটির প্রধান বিরোধী দল কনজারভেটিভ পার্টির প্রধান কেমি ব্যাডেনোচ। তিনি বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী কেয়ার স্টারমার তার ব্যক্তিগত বন্ধুকে দুর্নীতিবিরোধী মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ করেছেন। এতে তিনি নিজেই দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছেন।
এদিকে, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলাদেশেও তার ভাগ্নি টিউলিপের বিরুদ্ধে দুর্নীতির তদন্ত চলছে। শেখ হাসিনা, শেক রেহান, টিউলিপ সিদ্দিক ও সজীব ওয়াজেদ জয়ের বিরুদ্ধে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে প্রায় ৪০০ কোটি মার্কিন ডলার আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে।