
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোসহ সব অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা করে আগামী সপ্তাহে সিদ্ধান্ত নেবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। সংবিধান সংস্কার নাকি বাতিল হবে তাও সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
বৃহস্পতিবার (৯ জানুয়ারি) রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন সরকারের উপদেষ্টা মাহফুজ আলম।
তিনি বলেন, শুধু রাজনৈতিক দল নয়, গণ-অভ্যুত্থানের যতগুলো পক্ষ আছে সবার সঙ্গে কথা বলে সরকার আগামী সপ্তাহের মধ্যে প্রতিবেদনটির ব্যাপারে, কবে এ ঘোষণাপত্র, কিভাবে ঘোষণাপত্র প্রকাশিত বা ঘোষিত হবে তা সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্তটি জানাবে।
জুলাই অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র নিয়ে বিএনপিসহ রাজনৈতিক দল ও শিক্ষার্থীরা কথাবার্তা বলছেন উল্লেখ করে মাহফুজ আলম বলেন, এ বিষয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন বলছিল, ৩১ ডিসেম্বর তারা একটা ঘোষণাপত্র দেবে। কিন্তু সরকার তখন অনুভব করল, বৃহতপ্রক্রিয়ার বাইরে শুধু শিক্ষার্থীরা ঘোষণাপত্র দিলে জাতীয় ঐক্য ও স্থিতিশীলতার প্রতিকূল হতে পারে। তাই সরকার দায়িত্ব নিয়েছে, সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে সরকার একটি প্রতিবেদন তৈরি করবে।
১৫ জানুয়ারির মধ্যে ঘোষণপত্রের দাবি প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের দাবি ছিল ১৫ জানুয়ারি। যেহেতু সবার সঙ্গে কথা বলতে হবে, সে ক্ষেত্রে কিছু সময় বাড়তে পারে। কিন্তু খুব বেশি দেরি হবে না। হয়তো তাদের সময়সীমার কয়েকদিনের মধ্যে এটা হয়ে যাবে। সরকার চাচ্ছে সব পক্ষের সঙ্গে ঐকমতের মাধ্যমে হোক। আমরা মনেকরি শিক্ষার্থীরা ধৈর্যধারণ করবে, সংযম দেখাবে। এটা সর্বসম্মতিক্রমে হলে বাংলাদেশের জন্য ভালো হবে।
এ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কবে থেকে আলোচনায় সরকার বসবে— এমন প্রশ্নে মাহফুজ আলম বলেন, অনানুষ্ঠানিকভাবে ৩১ ডিসেম্বর থেকেই অনেকের সঙ্গে আলোচনা করেছি। আনুষ্ঠানিকভাবে আগামী সপ্তাহ থেকেই বসা শুরু করব।
ঘোষণাপত্রের দুটো দিক থাকে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সেট হল কী কারণে করছি এবং কী চাচ্ছি। আমরা এ কারণে ঘোষণাপত্র চাচ্ছি তা হচ্ছে তা হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এ বিষয়ে ঐক্যমত আছে, সেটা হচ্ছে শেখ হাসিনার ফ্যাসিজম ও সেটার ধারাবাহিকতা হয়তো ঘোষণাপত্রে বর্ণনা করব। ঘোষণাপত্রের দ্বিতীয় ভাগে থাকবে রাষ্ট্রটা কিভাবে পরিচালিত হবে। সেসব বিষয়ে কয়েকটি বিষয়ে ঐক্যমত বা বিতর্ক থাকতে পারে অথবা আরাও বেশি আলোচনার দরকার হতে পারে।
মাহফুজ আলম বলেন, বিএনপি বলেছে তাদের ১৬ বছরের দীর্ঘ গণতান্ত্রিক সংগ্রামের স্বীকৃতি হোক। শুধু তাদের নয়, যত রাজনৈতিক দল, সাংস্কৃতিক সংগঠন বা বিভিন্ন ব্যক্তি বিশেষের সংগ্রামের ইতিহাস আছে। যারা যারা নিপীড়নের শিকার হয়েছে সবার কথাই ঘোষণাপত্রে থাকবে। এছাড়া যে কেউ তাদের প্রস্তাবনা দিতে পারে। কারণ আমরা চাচ্ছি একটা অংশগ্রহণমূলক প্রতিবেদন।
ঘোষণাপত্রের একটি প্রস্তাবনা এরই মধ্যে শিক্ষার্থীরা দিয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ঘোষণাপত্র কিন্তু সরকার দেবে না। সরকার ঘোষনাপত্র ও তার প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করতে। কিন্তু ঘোষণাপত্র আসবে সব রাজনৈতিক দল ও অংশীজনের ঐক্যমতের ভিত্তিতে। সরকার বানিয়ে কোন ঘোষণাপত্র দেবে না। শিক্ষার্থীদের প্রস্তাবনা ও সবার ঐক্যমতে ঘোষণাপত্র আসবে।
সংবিধান নিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অবস্থানের বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে মাহফুজ আলম বলেন, এ বিষয়ে শিক্ষার্থীদের দাবি আছে। বাহাত্তরের সংবিধান যখন তৈরি হয়েছিল তখন থেকেই সমালোচনা করেছিল রাজনৈতিক দলগুলো। বর্তমান বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে যেটা দরকার তা হচ্ছে জাতীয় ঐক্যমত দরকার। সংবিধানের বিষয়ে শিক্ষার্থীদের প্রস্তবনা আছে। আবার অন্যান্য রাজনৈতিক দলের বিরোধিতা আছে। যেসব বিষয়ে ঐক্যমত আছে, তা আমরা লিপিবদ্ধ করব। সংবিধান সংস্কার নাকি বাতিল হবে তা আলোচনার ভিত্তিতেই হবে।
স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে তিনি বলেন, প্রশাসক দিয়ে জনগণের কাছে সেবা পৌঁছাতে পারব কিনা? তা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। স্থানীয় সরকারের অনেক সেবা জনগণ নিয়মিত পাচ্ছে না। তাই প্রশাসক দিয়ে সামলানোতে আমরা ঘাটতি দেখতে পাচ্ছি। তাই প্রস্তাবনা আকারে প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন স্থানীয় সরকার নির্বাচন হলে নাগরিকদের সেবাপ্রাপ্তির সুযোগ তৈরি হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে অগ্রসর হতে পারব।
স্থানীয় সরকার নির্বাচনের নিরাপত্তা দিতে পুলিশ ও আনসারের প্রস্তুতির বিষয়ে মাহফুজ আলম বলেন, পুলিশে সংস্কার করা হবে। একই সঙ্গে আনসারকেও ঢেলে সাজানো হবে। কিন্তু এমন না যে আমরা আগামী মাস বা তিনমাস পরে নির্বাচন দিয়ে দিচ্ছি। আমরা সময় সীমা বলেনি। বলেছি প্রস্তুতি চলমান আছে। যার অনেকগুলো পর্ব থাকতে পারে। যার প্রশাসনিক প্রস্তুতি নিচ্ছি। তবে আইনশৃঙ্খলার প্রস্তুতি নিচ্ছি না। আমরা মনেকরি স্থানীয় সরকার নির্বাচন হলে জনগণের কাছে দ্রুত সেবা পৌঁছে দিতে পারব। পুলিশ সংস্কার ও আনসারকে ঢেলে সাজানো সংস্কার প্রক্রিয়ার অংশ। এটা ঘটবে। তখন আমরা চাইব পুলিশ আগের ভূমিকায় না থাকে।
জাতীয় নির্বাচন কবে হতে পারে এমন প্রশ্নে উপদেষ্টা বলেন, প্রধান উপদেষ্টা এরই মধ্যে বলেছেন জাতীয় নির্বাচন হচ্ছে সংস্কার সাপেক্ষ। নির্বাচন সংশ্লিষ্ট সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন এ মাসেই পাব। তাদের প্রস্তাবনাগুলো হবে নির্বাচনকেন্দ্রিক। সেগুলো নিয়ে রাজনৈতিক দল ও অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করব। সেখানেই রাজনৈতিক দলগুলো ঠিক করবে কতটা সংস্কার করতে চায়। সংস্কারের মেয়াদ বা পরিধির ভিত্তিতে নির্বাচনের সময় নির্ধারিত হবে। এটা আজকালের মধ্যে ঠিক হওয়াটা যৌক্তিক হবে বলে মনে করি না।
৫ আগস্টের পরে মাজার, কাওয়ালী ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের হামলার বিষয়ে মাহফুজ আলম বলেন, বিভিন্ন জায়গায় হামলা হয়েছিল কিন্তু অনেকক্ষেত্রে স্পষ্ট পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হয়নি, সে জন্য দুঃখিত। কিন্তু এখন থেকে মাজার, কাওয়ালী বা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে হামলা হলে আমরা কঠোর ব্যবস্থা নেব। কাউকে ছাড় দেব না। এ বিষয়ে সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ময়মনসিংহের ঘটনার পদক্ষেপ নিচ্ছি। ৫ আগস্টের পরে সব ঘটনার তথ্য সংগ্রহ করেছি, দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব। একই সঙ্গে ক্ষুব্ধদের মামলা করার অনুরোধ জানান তিনি।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম, উপপ্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার, অপূর্ব জাহাঙ্গীর।